সময়রেখার পেছনের মানুষটি : খোরোশকোভা লিলিয়ার (১৯৯২-২০২০) স্মৃতিতে

Spread the love

[লেখক ইরফানুর রহমান রাফিন তাঁর সময়রেখা বইটি উৎসর্গ করেছেন তরুণ জৈবপ্রযুক্তিবিদ খোরোশকোভা লিলিয়াকে। ২০২০ সালের ৩ জুন চলে যান লিলি। দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।]

লিলিয়া কলেজে আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল। সামান্য পরিচয় ছিল। ওকে দূর থেকে দেখে একটু অবাক হতাম। মুখের ধাঁচ গায়ের রঙ কিছুই বাঙালিসুলভ নয়। নামটাও কেমন জানি। বিদেশি বিদেশি লাগে। অথচ আমার জানা ছিল সে মানিকগঞ্জের মেয়ে।

এসব ক্ষেত্রে যা হয়, এক জুনিয়রকে ধরলাম। সে আমাকে জানাল মেয়েটা পুরোপুরি বাঙালি নয়। মায়ের দিক থেকে শরীরে রুশ রক্ত আছে।

ছোটবেলা থেকেই রুশ সাহিত্যের সাথে পরিচয় ছিল। আলেকজান্দার পুশকিনের ক্যাপ্টেনের মেয়ে খুব প্রিয় ছিল। পুশকিনের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র ছিল মাশা। উপন্যাসের নায়ক মাশার প্রেমে পড়েছিল, সেইসূত্রে আমিও। বড় হতে হতে মাশার কথা ভুলে যাচ্ছিলাম। পুরোপুরি ভুলে যেতাম। যদি না লিলির সাথে দেখা হত আমার।

আমার এক কাজিন ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। সেই অ্যাকাউন্টে রোমান হরফে বাংলা লিখি আমি। অদ্ভুত সব পোস্ট। অনেককিছুর মতো সেই অ্যাকাউন্টটাও আমি হারিয়ে ফেলেছি। এমনই একদিন আমি ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই। সে একসেপ্ট করে। ইনবক্সে টুকটুক করে আমাদের আলাপ হতে থাকে।

তখন আমি লালমাটিয়ায়। কিছুদিনের জন্য আম্মুর এক বান্ধবীর বাসায় উঠেছি। অ্যাডমিশন টেস্ট সামনে।

তাই কোচিং করছি। তারচেও বেশি মাথা ঘামাচ্ছি বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে। সেবার স্পেন শিরোপা জিতেছিল, মনে আছে, কারণ আমি স্পেনের একটা ছোট পতাকা কিনেছিলাম।

বিকালবেলা আমার কাজ ছিল লালমাটিয়ার অলিগলিতে হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে একদিন একটা সাইবার ক্যাফে দেখলাম। শুরু করলাম যাতায়াত।

প্রতিদিনই যাই সেখানে। লিলিকে মেসেজ দেই। প্রায়ই অনলাইনে সে থাকে না সেই সময়। রিপ্লাইয়ের জন্য একটা দিন অপেক্ষা করতে হয়। যন্ত্রণা আর আনন্দে মেশানো অদ্ভূত সেই অপেক্ষা। খুবই আটপৌরে আলাপই হয়তো হচ্ছে আমাদের মধ্যে। কিন্তু কল্পনা করছি, সে আঙুল দিয়ে টাইপ করছে সেই কথাগুলো, ভেবে সারা শরীরে জলতরঙ্গের মতো শিহরণ হচ্ছে।

আস্তে আস্তে এক ধরণের বন্ধুত্ব তৈরি হলো। কিছুটা পাত্তা পেয়ে আমার সাহস বেড়ে গেল। তারপরই ভুলটা করলাম।

না, কারো প্রেমে পড়া ভুল না কোনো। কাউকে প্রপোজ করা, সেটাও কোনো ভুল না। ভুলটা ছিল ধরণে।

ভুলটা কী ছিল আমি লিখতে চাচ্ছি না। হয়রানি জাতীয় কিছু না। তবে অ্যাপ্রোচটাকে অ্যাবসার্ড বলা যেতে পারে।

লিলির জায়গায় যদি অন্য কোনো মেয়ে থাকত, সে নিশ্চয়ই আমার ওপর ক্ষেপে যেত। ফোন করে আমার সাথে রুড বিহেভ করত। হয়তো অপমানও করত।

কিন্তু সে অন্য কোনো মেয়ে ছিল না।

সে লিলি ছিল।

পৃথিবীতে ওর মতো মেয়ে দুইটা আসে না।

লিলি আমাকে বলেছিল, আপনি এটা কী করলেন? আমার সাথে একবার কথা বলে নিতে পারতেন। আপনাকে আমি বন্ধু মনে করি, কিন্তু এরচে বেশি কিছু না, বুঝলাম না আমার বন্ধুত্বকে কেন ভালোবাসা মনে হল!

তারপরই সে বলে, মানুষের ভুল হতে পারে। তাছাড়া আপনি তো নোংরা কিছু করেন নাই। প্রপোজ করেছেন, তা ধরণটা যতো অ্যাবসার্ডই হোক।

আমি রিজেকশনের কারণে কষ্ট পেয়েছিলাম এটা ঠিক। কিন্তু ওর আচরণ দেখে অভিভূত হয়ে গেছিলাম। মানুষ এমনও হয়!

এর মধ্যেই আমার এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল। খুবই খারাপ করলাম। আমার আর ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হবে না। আব্বু খুব কষ্ট পেল, কাঁদতে দেখলাম একদিন। কী মনে করে আমি লিলিকে জানালাম কথাটা। সে আমাকে খুবই কোমলভাবে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আপনি ভাববেন না, একদিন আপনার বাবা আপনার জন্য গর্বিত হবে।

এরপর আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। আমার সেই অ্যাকাউন্টটাও একদিন অচল হয়ে যায়। নতুন অ্যাকাউন্টে ওকে অ্যাড করা হয় নি, সত্যি বলতে গেলে, ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর সাহস হয় নি।

আমি ঢাবিতে চান্স পেয়ে ঢাকায় চলে এলাম। ততদিনে জিগাতলায় আমাদের নিজেদের একটা ফ্ল্যাট হয়েছে। আমাদের ভাড়া বাসায় থাকার দিন শেষ হয়েছে। সেও তার সময় এলে এইচএসসি পরীক্ষা দিল। এরপর একটা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। জীবন আমাদের দুজনকে দুই দিকে নিয়ে গেল। কয়েক বছর পরে সে বিয়ে করে একজনকে, কত সালে সেটা আমি জানি না, বুঝলাম জীবনে ওকে আমার আর পাওয়া হবে না।

এরপর একদিন হঠাৎ লিলিকে ঢাকার রাস্তায় দেখলাম। একটু দূর থেকেই। ভিড়ভাট্টার কারণে কাছে যাওয়ার সুযোগ পাই নি।

নতুন অ্যাকাউন্টটা থেকে ওকে খুঁজে বের করি। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই নাই, মনে ভয় ছিল, যদি এতোদিন পরে আমাকে না চেনে! তাই ছয়মাসে নয়মাসে ওর অ্যাকাউন্টে যেতাম, নতুন কোনো ছবি থাকলে দেখতাম, মাঝেমধ্যে সাহস করে লাইকও দিয়ে ফেলতাম।

সম্ভবত ২০১৪ সালে, একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটে। সে একদিন আমার অ্যাকাউন্ট ফলো করে। নো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, নো মেসেজ, জাস্ট ফলো।

আমি সিদ্ধান্ত নেই, আর ভুল করব না। আগেরবার স্টুপিডিটি করতে গিয়ে ওর বন্ধুত্ব হারিয়েছে। দ্বিতীয়বারের মতো ওকে আর হারাতে চাই না।

তাই আমি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলাম না। মনে মনে খুশী হলাম, অসম্ভব খুশী হলাম। কিন্তু অনুভূতিটা মনেই রাখলাম।

২০১৬ সালে আমার জীবনে একটা ঝড় আসে। আমার মায়ের কিডনির অসুখ ধরা পড়ে, কিছুকালের মধ্যেই তার ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয়। এরপর আমার ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় একটাই, যেভাবেই হোক না কেন, আম্মুকে বাঁচাতে হবে।

পরের কয়েকটা বছর আম্মুই ছিল আমার সবকিছু।

লিলির কথা ভুলে যাই নি আমি। কিন্তু সে আমার মাসুমিয়াতের মিউজিয়ামে ঢুকে গেছিল। ২০২০ সালের মে পর্যন্ত।

এর মধ্যে লিলির জীবনেও নানান পরিবর্তন আসে। জৈবপ্রযুক্তি নিয়ে পড়তে সে এনএসইউ’তে ভর্তি হয়। শিল্পসংস্কৃতিতে আগ্রহী ছিল। তাই একসময় সে প্রাচ্যনাটের সাথে যুক্ত হয়। সব্যসাচী আর সুবর্ণাদের সাথে একটা ছবি করে। ওর পার্টটা ছোট ছিলো, ওর পেশারই, দন্ত্যচিকিৎসকের। সুবর্ণা মুস্তফার সহকারীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিল লিলি।

সেইসূত্রে সিনেমাজগতের কেউ কেউ ওকে চিনে থাকবে। তেমনই একজনের পোস্ট দেখলাম, সে আর নেই। আমার পৃথিবী ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। শোক সামলে উঠে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলাম। সকালে আমার আর লিলির দুজনেরই জুনিয়র ছিলো, এমন একটা ছোট ভাই আমাকে জানাল যে, লিলি বেঁচে আছে। তবে কন্ডিশন ভালো না, লাইফ সাপোর্টে আছে। সলিমুল্লাহ মেডিক্যালের আইসিইউতে।

লিলি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে স্ট্রাগল করেছে।

আমি এই সময় মোট দুইবার ওকে দেখি। সারা জীবন ওকে দূর থেকেই দেখেছি আমি। এই প্রথমবার ওকে কাছ থেকে দেখতে পেলাম।

আমি ওর জন্য একবেলা অষুধ কিনে দেয়া ছাড়া আর ওর ডাক্তারদের কল করে খোঁজখবর নেয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারি নি। শুধু একদিন রাতে হাঁটতে হাঁটতে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত চলে গেছি, সড়ক বিভাজকের উপরে বসে ওর জন্য কেঁদেছি। আইসিইউতে দেখলাম ও মাথার চুল ফেলে দিয়েছে; দেখে এতো খারাপ লাগে আমার, সেদিন সন্ধ্যায় সেলুনে গিয়ে আমিও মাথার চুল ফেলে দেই।

কবিতায় ভালোবাসার জন্য বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে ১০৮টি নীল পদ্ম খুঁজে আনা যায়, বাস্তবে হয়তো এটুকুই করার থাকে।

জুন মাসের ৩ তারিখে লিলি মারা যায়। আমি যখন সিমেটারিতে পৌঁছাই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মুখে মাস্ক পড়া একদল মহিলা ওর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর একদল লোক ওর কবর খুঁড়ে যাচ্ছে।

বৃষ্টি হচ্ছিল খুব।

কবর দেয়া শেষ হলে, সবাই যখন ওখান থেকে চলে যায়, আমি একটা গাছ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। লিলিয়ার ভালোবাসা আমার পাওয়া হয় নি, ওর সাথে আমার সংসার করা হয় নি। জীবনে নয়, আমি লিলিকে তার মৃত্যুতে পেয়েছিলাম।

এরচে বেশি কিছু আমার প্রয়োজন ছিল না।

4 thoughts on “সময়রেখার পেছনের মানুষটি : খোরোশকোভা লিলিয়ার (১৯৯২-২০২০) স্মৃতিতে”

  1. *অদ্ভুত
    *হয়রানি
    হাসনাত শোয়েব এরকম একটা কথা মনে হয় বলেছিলেন, মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য অপরের স্মৃতিতে বেঁচে থাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *